মানিকগঞ্জের দর্শনীয় স্থান
০১। বালিয়াটি প্রাসাদ, সাটুরিয়া
মানিকগঞ্জ জেলার পুরাকীর্তির ইতিহাসে বালিয়াটির জমিদারদের অবদান উল্লেখ যোগ্য। বালিয়াটির জমিদারেরা ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকে আরম্ভ করে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত প্রায় শতাধিক বছর বহুকীর্তি রেখে গেছেন যা জেলার পুরাকীর্তিকে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছে। বালিয়াটির পাঠান বাড়ীর জমিদার নিত্যানন্দ রায় চৌধুরীর দু’ছেলে বৃন্দাবন চন্দ্র রায় চৌধুরী এবং জগন্নাথ রায় চৌধুরীর মাধ্যমে বালিয়াটির নাম দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। বালিয়াটিতে আজও দু’বেলা রাধা বল্লব পূজো হচ্ছে। বালিয়াটিতে ১৯২৩ সালের দিকে জমিদার কিশোরী রায় চৌধুরী নিজ ব্যয়ে একটি এলোপ্যাথিক দাতব্য চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। বর্তমানে এটি সরকারী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। জমিদার হীরালাল রায় চৌধুরী সাটুরিয়া থেকে বালিয়াটির প্রবেশ পথের পাশে কাউন্নারা গ্রামে একটি বাগানবাড়ী নির্মাণ করেন এবং সেখানে দিঘির মাঝখানে একটি প্রমোদ ভবন গড়ে তোলেন যেখানে সুন্দরী নর্তকী বা প্রমোদ বালাদের নাচগান ও পান চলতো। বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর দৃষ্টিনন্দন ও প্রাসাদের রক্ষনাবেক্ষণ করছে।
০২। তেওতা জমিদার বাড়ী , শিবালয়
মানিকগঞ্জ উপজেলাধীন শিবালয় উপজেলার তেওতা জমিদার বাড়িটি বাবু হেমশংকর রায় চৌধুরী, বাবু জয় শংকর রায় চৌধুরী পিং দুই সহোদর ভ্রাতার নিজ বসতবাড়ী ছিল। তেওতা অবস্থান করে তারা জমিদারি পরিচালনা করতেন। এই জমিদার বাড়ির মোট ৫৫ টি কক্ষ এখন জরাজীর্ন অবস্থায় আছে এবং ৫৬ টি নদীভাঙ্গা পরিবারঅবৈধভাবে বসবাস করছে।
০৩। তেওতা নবরত্ন মঠ, শিবালয়
১৯৪৭ সনে ভারত বিভক্তির প্রাক্কালে তৎকালীন জমিদারগণ এদেশ ত্যাগ করে ভারতের কলিকাতা গমন করেন এবং তথায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। জমিদারগণ চলে যাবার পর তাদের নামীয় সম্পত্তি বংলাদেশ সরকারের অনুকূলে রেকর্ডভূক্ত হয়। পুরো বাড়িটি সংস্কারের জন্য জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন। বাড়িটি উত্তরে এবং দক্ষিন-পশ্চিম কোনে দু’টি পুকুর রয়েছে এবং পুকুরের পূর্ব পাশ দিয়ে একটি সরকারী পাকা রাস্তা চলমান আছে। দালানের ভিতরে দুটি মন্দির ও একটি মঠ আছে; যা ‘‘মানবরত্ন’’ নামে পরিচিত। উহা সম্পূর্ন জরাজীর্ন।
০৪। মানিকগঞ্জের মত্তের মঠ
বর্তমান মানিকগঞ্জ সদরের দেড় মাইল পূর্বে মত্ত গ্রামটিতে এক সময় প্রতাপশালী জমিদারদের বসবাস ছিলো। তাদের মধ্যে রামকৃষ্ণ সেন এবং তার ছেলে প্রসন্ন কুমার সেনের নাম উল্লেখযোগ্য। মানিকগঞ্জের পুরাকীর্তির ইতিহাসে সদর উপজেলার মত্ত গ্রামের গুপ্ত পরিবারের অবদানের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এ পরিবারের আদি পুরুষ ছিলেন শিবানন্দ গুপ্ত। শিবানন্দ, প্রভাস গুপ্ত, শিশির গুপ্ত এবং প্রবোধ গুপ্ত পর্যন্ত মোট ২৩ পুরুষের সন্ধান জানা গেছে। গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা শিবানন্দ গুপ্ত নামকরা কবিরাজ ছিলেন। তিনি পাঠান সেনাপতি মীর মকিমের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। অনুমিত হয় যে, বাংলাদেশে পাঠান শাসনামলে মত্তের গুপ্ত বংশীয় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ এ এলাকায় যেমন বিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করেছিলো তেমনি ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্রে তাদের অগাধ বুৎপত্তি প্রবাদের মতো লোকমুখে আজও উচ্চারিত হয়।
০৫। রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম
মানিকগঞ্জের পুরাকীর্তির ইতিহাসে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি গ্রামের রামকৃষ্ণ মিশনের দেবাশ্রম একটি উল্লেখযোগ্য দিক। ১৯১০ খৃীষ্টাব্দের সমাজ সচেতন জনগোষ্ঠীর উদ্দীপনায় শ্রী রাধিকা চরণ অধিকারী ওরফে শ্রী স্বামী সুন্দরানন্দজী মহারাজ সেবাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশের মধ্যে মোট দশটি মঠ ও মিশন কেন্দ্রীয় মঠ কর্তৃক স্বীকৃতি পেয়ে আসছে - তার মধ্যে এটি অন্যতম। এখানে সুদৃশ্য পাকা মন্দিরে বিগ্রহের পূজা অর্চনা হয় এবং মন্দির সংলগ্ন ভবনে একটি গ্রন্থগার আছে। বালিয়াটির জমিদার দীনেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরীর পুণ্যস্মৃতির রক্ষার্থে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের জন্য ১৩৩১ সালে একটি পাকা ইদারা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন।
০৬। শিব সিদ্ধেশ্বরী মন্দির
মহারানী ভিক্টোরিয়ার আমলে শিব সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত। মানিকগঞ্জের শিব সিদ্ধেশ্বরী মন্দির এ জেলার পুরাকীর্তির মধ্যে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে তিন ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট প্রস্তরময় সিদ্ধেশ্বরী মূর্তি, একটি মাঝারী আকারের শ্বেত পাথরের শিবের বাহন ষাঁড় ও অষ্টধাতুর দুর্গা মূর্তি এবং আরো কিছু ভাস্কর্যের নিদর্শন ছিল। কিন্তু সবগুলোই ১৯৬১-৬২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে চুরি হয়ে গেছে। বর্তমানে সিমেন্টের সিদ্ধেশ্বরী শিব পূজিত হচ্ছে। শিব সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরটির নিজস্ব কোন আয়ের উৎস না থাকায় দীর্ঘদিনের প্রাচীন মন্দির অর্থাভাবে মেরামতের কোন কাজ হয়নি। মন্দিরের ছাদ যে কোন সময় ধ্বসে পড়ার উপক্রম। বর্তমানে স্থানীয় ১৫ সদস্য বিশিষ্ট ম্যানেজিং কমিটির মাধ্যমে মন্দিরটির ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম চলছে। নিত্য পূজা অর্চনা অনুষ্ঠানের জন্য একজন পুরোহিতকে মাসিক বেতন ও আবাসিক সুবিধার ভিত্তিতে নিয়োগ করে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
০৭। মানিকগঞ্জের শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ীঃ
মানিকগঞ্জ শহরে (তৃপ্তি সিমেনা হলের পূর্বে) শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৯৫-৯৬ সালের দিকে। শ্রী শ্রী কালীমাতা শিব এবং রাধা কৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপনের জন্য তিন কামরা বিশিষ্ট পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়। উক্ত কামরাগুলোর সবচাইতে পূর্ব দিকের কামরায় শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীমায়ের প্রস্তর মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্তমানে শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালী মন্দিরে প্রাত্যহিক পূজা এবং বিভিন্ন বিশেষ পালা পার্বনে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি নির্বাচিত কমিটি ও স্থানীয় পুরোহিত কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের সাধারণ সদস্য এবং আজীবন সদস্য মিলে মোট একুশ জন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির দ্বারা সার্বক্ষনিক পূজা অর্চনা করার জন্য মাসিক বেতনে একজন পুরোহিত নিয়োগের ব্যবস্থা আছে। এ মন্দিরটির আয়ের উৎস হলো ভক্তবৃন্দের অনুদান ও সদস্যগণের চাঁদা। বর্তমানে রথের দিনগুলিতে মন্দির প্রাঙ্গণসহ শহরের বিস্তৃত এলাকা জুড়ে মেলা বসছে এবং মঠ মন্দিরে মাঝে মাঝে ধর্মসভা, অষ্টপ্রহর, নামকীর্তন ও যাত্রাভিনয়াদি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
০৮। মানিকগঞ্জের গৌরাঙ্গ মঠ
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বালিয়াটির নয়া তরফের জমিদার মনমোহন রায় চৌধুরী তার স্বর্গীয় পত্নী ইন্দুবালা এবং আদরের দুলালী সুনীতিবালার পুণ্যস্মৃতি রক্ষার্থে বালিয়াটির বিখ্যাত এবং ভারতের উল্লেখযোগ্য গদাই গৌরাঙ্গ মঠের স্বীকৃতপ্রাপ্ত শাখা মঠ স্থাপন করেন। সুউচ্চ চূড়া সমন্বিত মারবেল পাথরের গাত্রাবড়নে উচ্চ পাদপীঠে নির্মিত এই গদাই গৌরাঙ্গ মঠটি মানিকগঞ্জে পুরাকীর্তির গৌরব। তবে ১৯৭১ সনে স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তান বাহিনী মঠটি ভাঙ্গার চেষ্টা করে এবং পাথরের তৈরী গদাই গৌরাঙ্গ মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেছে। এক সময় বৎসরান্তে এ মঠে সমারোহের মধ্য দিয়ে পূজা অর্চনা ও ধর্মালোচনা হতো। দুর দুরান্ত থেকে ভক্ত আর অনুরাগীরা এখানে এসে জমা হতো। বর্তমানে মন্দিরটি কালের স্বাক্ষী হিসেবে টিকে আছে।
০৯। নারায়ন সাধুর আশ্রম
মানিকগঞ্জের সদর উপজেলার মত্ত গ্রামের আর একটি পুরাকীর্তি নারায়ন সাধুর আশ্রম। সাধুর বাড়ী ছিল উড়িষ্যা। উড়িষ্যা থেকে সাধু একটি বৃহৎ প্রস্তর খন্ড এনে আশ্রম স্থাপন করেন। এখানে পাথর আর ত্রিশুল পূজিত হচ্ছে। এখানে পাকা ভবন নির্মিত হয় ১৩৪৮ সালে। সাধুর আশ্রম হিসাবে এখনো এখানে ভক্তগণেরা জমায়েত হন।
১০। মাচাইন গ্রামের ঐতিহাসিক মাজার ও পুরোনো মসজিদ
মানিকগঞ্জের মুসলিম পুরাকীর্তির বেশীর ভাগই বাংলার স্বাধীন সুলতানী আমল ও পরবর্তী মুসলিম শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ সময়ে প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি জামে মসজিদের মধ্যে মাচাইন গ্রামের মসজিদ অন্যতম। স্বাধীন সুলতানী আমলে মাচাইন একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম ছিল। এখানে একজন দরবেশ একটি বাঁশের মাচায় বসে আধ্যাত্বিক চিন্তা করতেন। এই দরবেশের নাম হযরত শাহ্ রুস্তম। বর্তমানে মাচাইন গ্রামে শাহ্ রুস্তমের মাজার জিয়ারত মানিকগঞ্জ জেলাসহ আশেপাশের অঞ্চলের মানুষের কাছে একান্ত শ্রদ্ধার বিষয়। এই মাচাইন গ্রামের ঐতিহাসিক মাজার ও পুরোনো মসজিদটি মানিকগঞ্জের মুসলিম পুরাকীর্তির দু’টি বিশেষ নজির হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
১১। কবিরাজ বাড়ী
বর্তমান মানিকগঞ্জ সদরের দেড় মাইল পূর্বে মত্ত গ্রামটিতে এক সময় প্রতাপশালী জমিদারদের বসবাস ছিল। তাদের মধ্যে রামকৃষ্ণ সেন এবং তার ছেলে প্রসন্ন কুমার সেনের নাম উল্লেখযোগ্য। মানিকগঞ্জের পুরাকীর্তির ইতিহাসে সদর উপজেলার মত্ত গ্রামের গুপ্ত পরিবারের অবদানের স্বীকৃতি পাওয়া যায়। এ পরিবারের আদি পুরুষ ছিলেন শিবানন্দ গুপ্ত। শিবানন্দ, প্রভাস গুপ্ত, শিশির গুপ্ত এবং প্রবোধ গুপ্ত পর্যন্ত মোট ২৩ পুরুষের সন্ধান জানা গেছে। গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠাতা শিবানন্দ গুপ্ত নামকরা কবিরাজ ছিলেন। তিনি পাঠান সেনাপতি মীর মকিমের পারিবারিক চিকিৎসক ছিলেন। অনুমিত হয় যে, বাংলাদেশে পাঠান শাসনামলে মত্তের গুপ্ত বংশীয় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিবর্গ এ এলাকায় যেমন বিশেষ প্রাধান্য বিস্তার করেছিল তেমনি ভেষজ চিকিৎসা শাস্ত্রে তাদের অগাধ বুৎপত্তি প্রবাদের মতো লোকমুখে আজও উচ্চারিত হয়।
১২। বাঠইমুড়ী মাজার
এ মাজারটি ঘিওর উপজেলায় অবস্থিত। এখানে সমাহিত আছেন আফাজ উদ্দিন পাগলা এবং তার শিষ্য শরীয়ত উল্লাহ। এটি আনুমানিক দেড় থেকে দুইশত বছরের পূর্বের মাজার বলে ধারনা করা হয়। বর্তমানে এখানে একটি বড় মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
১৩। ঈশ্বর চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়, সাটুরিয়া
মানিকগঞ্জের পুরাকীর্তির মধ্যে সাটুরিয়া উপজেলার বালিয়াটি ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় অন্যতম। বালিয়াটির জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র রায় চৌধুরীর নামানুসারে স্কুলটির নাম ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় হয়েছে। ১৯১৫-১৬ খ্রিষ্টাব্দে ঈশ্বরচন্দ্রের পুত্র হরেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী স্কুলটির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমত স্কুলটির নামকরণ করা হয়েছিল ঈশ্বরচন্দ্র হাই ইংলিশ স্কুল। হরেন্দ্র কুমার চৌধুরী প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা ব্যয়ে করে স্কুলটির সুদীর্ঘ এবং সুদৃশ্য পাকা ভবন নির্মাণ করে দেন। বর্তমানে মানিকগঞ্জের পুরাকীর্তি স্মৃতি বিজড়িত এ স্কুলটি স্থানীয় স্কুল কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার, সাটুরিয়া স্কুল কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।
Planning and Implementation: Cabinet Division, A2I, BCC, DoICT and BASIS