মানিকগঞ্জ জেলার গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামীলীগের ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার যে সুষ্পষ্ট রায় ঘোষিত হয় তাকে পদদলিত করে বাংলার মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে ক্ষমতাসীন পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বেতার ঘোষণায় ৩ মার্চের পূর্ব নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ঐ দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে স্মরণকালের বৃহত্তম ছাত্রসভায় সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয় এবং ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পল্টনে এক জনসভায় আন্দোলনের এক কর্মসূচি ঘোষণা করেন এবং ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’-এর আহবানে সাড়া দিয়ে দেশের অন্যান্য স্থানের মত মানিকগঞ্জের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্বপ্রস্তুতির পটভূমি তৈরি হয়।
জানা যায়, এ সময়ে দেবেন্দ্র কলেজ থেকে সংগৃহীত ইউ. ও. টি .সি-এর ড্যামী রাইফেল নিয়ে জাতীয় পরিষদ সদস্য মোসলেম উদ্দিন খান হাবু মিয়ার বাসার সামনে বর্তমান শিশু মঞ্জুরীর উন্মুক্ত স্থানে ছাত্রদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এই প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণ ২৫ মার্চ পর্যন্ত চলেছিল বলে জানা যায়। উক্ত সময়ের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অবস্থার পর্যালোচনা ও বিধি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রায়ই সভা সমিতিতে মিলিত হতেন।
২৫ মার্চ রাতেই তরাতে অবস্থিত তৎকালীন ই.পি.আর.টি.সি.ডিপোতে চাকরিরত সামরিক বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন স্থানে গণসংযোগের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। ঐদিন রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা পাক সৈন্যবাহিনী যাতে আরিচা ফেরীর সাহায্যে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে পারাপার না হতে পারে সেজন্য সবগুলো ফেরীকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তা সাথে সাথে কার্যকর করা হয়। পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুসারে ব্যারিকেডের সৃষ্টি করা হয় এবং অস্ত্র চালনায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দিয়ে নয়ারহাটে পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার ব্যবস্থা করা হয়। ঐ রাতেই মানিকগঞ্জের ট্রেজারীতে রক্ষিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ বের করে নিয়ে ছাত্র ও যুবকদের মধ্যে বিতরণ করা হয় এবং বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানের এক বেতার ঘোষণায় সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং আওয়ামীলীগকে বেআইনী ঘোষণা ও নেতাবৃন্দকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেয়া হয়। ২৮ শে মার্চ সকালে হঠাৎ করে প্রখ্যাত ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মনি মানিকগঞ্জে আগমন করেন। তার মাধ্যমে জানা যায় যে, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামান, তোফায়েল আহমেদ এবং সিরাজগঞ্জের ডা: হেনা লঞ্চযোগে মানিকগঞ্জ এসেছেন এবং সিরাজগঞ্জে যাবার নিরাপদ রাস্তা খুজছেন। ২৯ শে মার্চ সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলে দলে দলে জনগন ঢাকা ত্যাগ করে পায়ে হেটে মানিকগঞ্জ এর উপর দিয়ে গন্তব্য স্থলের দিকে রওয়ানা হয়। এ সময়ে মানিকগঞ্জের আপামর জনসাধারণ তাদের থাকা খাওয়াসহ সর্বপ্রকার সহযোগিতা করে এক উল্লেখযোগ্য নজির সৃষ্টি করে।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষ পর্যায়ে মানিকগঞ্জ শহরে পাক-বাহিনী প্রবেশের পূর্বে ৫/৭টি হেলিকপ্টারের সাহায্যে ঢাকা-আরিচা সড়কে বানিয়াজুরি নামক স্থানে বিপুল সংখ্যক ছত্রী সৈন্য নামাতে শুরু করেন। এর প্রায় ২ ঘন্টার মধ্যে ঢাকা-আরিচা সড়ক শত শত সাঁজোয়া গাড়িতে পূর্ন হয়ে যায়। পাক সৈন্যরা মানিকগঞ্জ প্রবেশ না করে উত্তরবঙ্গ দখলের জন্য সরাসরি আরিচার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয় এবং বিনা প্রতিরোধে আরিচা দখল করে নেয়। জানা যায় পাক-বাহিনী এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সড়ক পথে মানিকগঞ্জ অভিমুখে অভিযান চালালে ধামরাই এর নয়ারহাটে বাঁধার সম্মুখীন হয় এবং পরবর্তীতে হেলিকপ্টারের সাহায্যে ছত্রী সৈন্য দ্বারা ঢাকা-আরিচা সড়ক দখল করে। আরিচা দখলের সময় তারা বিপুল সংখ্যক ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং নিরীহ জনগনকে নির্বিচারে হত্যা করে।
ঢাকা-আরিচা সড়ক ও আরিচা দখলের দুই এক দিনের মধ্যে বিপুল সংখ্যক সৈন্য বিনা প্রতিরোধে মানিকগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে এবং মানিকগঞ্জ দখল করে নেন।
ইতোমধ্যেকুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভবের পাড়া গ্রামে বর্তমান ‘মুজিব-নগরে’ ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীনতার সনদ ঘোষনার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ রাষ্ট্র ঘোষিত এবং ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার’ গঠিত হবার সংবাদ প্রচারিত হবার সাথে সাথে জনগন ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে শক্তি ও অসীম মনোবলের সঞ্চার হয়। নেতাবৃন্দ বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পারেন যে, ভারতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলছে এবং ভারত সরকার বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সর্বোতভাবে সাহায্য সহযোগিতা করছে। উক্ত সংবাদে হরিরামপুরের বিপ্লবী পরিষদের কিছু নেতৃবৃন্দকে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে ভারত প্রেরণ করা হয়। ভারতের মুক্তিযুদ্ধ প্রশিক্ষণের জন্য স্থানীয় প্রশিক্ষণ শেষ করে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা যার মধ্যে অনেকেই নিজস্ব উদ্যোগে ভারতে চলে যান। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে মানিকগঞ্জ এর মুক্তিযোদ্ধারা পরিপূর্ণভাবে সংগঠিত হয় এবং পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুতি শুরু করে।
স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার আগস্ট মাসে মাধ্যমিক পরীক্ষা (এস.এস.সি) গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত মাধ্যমিক পরীক্ষা যাতে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন না হতে পারে সেজন্য মুক্তিযোদ্ধারা পরীক্ষা বানচালের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে এবং ঘিওর কেন্দ্রের পরীক্ষা বানচালের জন্য একদল মুক্তিবাহিনী সামান্য গোলাবারুদ নিয়ে ঘিওর উপস্থিত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা ভোর রাতেই অতর্কিতভাবে পাক বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমন করে গুলি ও গ্রেনেড নিক্ষেপ শুরু করে। ফলে পাক বাহিনীও গুলি বর্ষন শুরু করে। স্বল্পস্থায়ী এই যুদ্ধে কয়েকজন পাক সেনা আহত হয়। উল্লেখযোগ্য যে, মুক্তিযোদ্ধাদের মানিকগঞ্জে এটাই পাক বাহিনীর সাথে প্রথম যুদ্ধ।
১৮ আগস্ট পাক সেনা হরিরামপুরের লেছড়াগঞ্জে প্রবেশ করে। ফলে ৩ সেপ্টেম্বর পাক বাহিনী হরিনা হতে লঞ্চে সুতালড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলে সেখান মুক্তিযোদ্ধারা বীরবিক্রমে তাদের বাঁধা দেয় এবং লঞ্চের ক্ষতি সাধিত হলে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সেপ্টেম্বর মাসেই পাক বাহিনীর সাথে সুষ্ঠু কার্যকরী ও অপরিকল্পিতভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য হরিরামপুরেই চারটি কোম্পানি গঠিত হয়। এই চারটি কোম্পানি ছিল যথাক্রমে ALFA, BETA, CHARLEY, DELTA।মানিকগঞ্জের বিভিন্ন স্থানের যুদ্ধে চার কোম্পানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে জানা যায়।
২৪সেপ্টেম্বরের আজিমনগরের যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী পুনরায় দৃঢ় মনোবল এবং ব্যাপকভাবে অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকে। ইতিমধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নিয়মিত ভাবে ভারতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ শুরু হয়। ভারত থেকে পাঠানো রাইফেল, গ্রেনেডসহ বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্রে ভর্তি একটি নৌকা ঢাকা কেরানীগঞ্জ হয়ে আসার সময় কলাতিয়া নামক স্থানে পাক বাহিনী কর্তৃকধৃত হয় এবং তারা নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়।ফলে মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকদিন অদম্য মনোবল নিয়ে বহু কষ্ট করে ডুবিয়ে রাখা অস্ত্র উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। উক্ত অস্ত্র-গুলি পাবার পর মুক্তিযোদ্ধারা সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়াতে সক্ষম হয়।১৩অক্টোবর হরিরামপুরের সি.ও. অফিসে অবস্থিত পাকবাহিনী ক্যাম্প দখলেরপরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং প্রবল বাধার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও তারা উক্ত ক্যাম্প দখল করতে সক্ষম হয়।মুক্তিযোদ্ধাদের এই ক্যাম্প দখলে ৫জন বেলুচ সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ অবলম্বন করে যুদ্ধ করেছিল বলে জানা যায়। এ যুদ্ধে ৬০/৭০জন পাক সৈন্য নিহত এবং ৭০টি রাইফেল ৩টি এল.এল.জি ও ৭ বাক্সগুলি মুক্তিযোদ্ধাদের হস্তগত হয়।
হরিরামপুর ক্যাম্প দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা ১৪ অক্টোবর মানিকগঞ্জের বালিরটেকে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প দখলের পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুসারে রাজাকারদের সাথে গোপন চুক্তি হয় মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প দখলের জন্য গুলিবর্ষণ শুরু করলে রাজাকাররা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে পাকবাহিনীর উপর গুলিবর্ষণ করবে। কিন্তু পরে বিশ্বাসঘাতকতা করে মুক্তিবাহিনীর উপরেই গুলিবর্ষণ করেছিল। দীর্ঘক্ষণ গুলিবিনিময়ের একপর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা নওশেদ মোল্লা ও আবুল কাশেম ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং হাবীব গুরুতরভাবে আহত হন।
১৫ অক্টোবর দিবাগত রাত ৯টায় পাকবাহিনী সূতালড়ী গ্রাম আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল প্রতিরোধের সৃষ্টি করে এবং ঐ রাত হতে পরদিন সকাল দশটা পর্যন্ত প্রবল যুদ্ধ চলে। উপায়ন্তর না দেখে পাকসেনারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
১৭ অক্টোবর পাকসেনারা পুনরায় গানবোট সহকারে ভোর সাতটায় সূতালড়ী গ্রামে পুনরায় আক্রমণ করে। মুক্তিযোদ্ধারা এসময়ে পূর্বেই প্রস্তুত থাকায় উভয়পক্ষের তীব্র ও ব্যাপক গোলা বর্ষণ শুরু হয়, প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা পশ্চাদপসরণ বাধ্য হয়। ওইদিনই পাকসেনারা গানবোটে সজ্জিত হয়ে প্রায় তিনশত সৈন্য নিয়ে রংবাজ, খামার ডিঙ্গি, ইব্রাহিমপুর, দৌলতপুর প্রভৃতি স্থান দখল চেষ্টা চালায়। এ সমস্ত রণক্ষেত্র মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল প্রতিরোধ সৃষ্টি করে সারাদিন উভয়পক্ষে প্রচন্ড যুদ্ধের পর রণ-ক্লান্ত পাকসেনারা ফিরে যেতে বাধ্য হয়।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে মানিকগঞ্জের জুলাই মাস হতেই মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হতে শুরু করে এবং পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণ আরম্ভ করে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে মানিকগঞ্জে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্যাম্প স্থাপন করে। এরূপ একটি উল্লেখযোগ্য ক্যাম্প ছিল সিংগাইরের গোলাইডাঙ্গা স্কুলে। গোলাইডাঙ্গাতেই মানিকগঞ্জের সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ হয়েছিল। ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে- পাকসেনারা দশ-বারোটি নৌকায় করে তিন শতাধিক সৈন্যসহ গোলাইডাঙ্গা ক্যাম্প দখল করতে অগ্রসর হচ্ছে এমন খবর পাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযোদ্ধারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে গোলাইডাঙ্গা খালের মোড়ে এবং অন্য দলের অপর পাড়ে অবস্থান নেয়। ইতিমধ্যে পাকসেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের সন্ধানে স্কুলে যায় এবং কোন মুক্তিযোদ্ধার সন্ধান না পেয়ে ফিরে আসার সময় সবগুলি নৌকা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের আওতার মধ্যে আসে তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণের সম্মুখীন হয়। তীব্র আক্রমণে প্রায় সবগুলি নৌকা ডুবে যায় এবং প্রায় একশত সৈন্য ঘটনাস্থলেই নিহত হয় । কিছু সৈন্য নৌকা থেকে আত্মরক্ষার জন্য লাফিয়ে পানিতে পড়লে মুক্তিযোদ্ধারা পানিতে নেমেই তাদের হত্যা করে।
এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী এল.এম.জি.এস, এল.আর. ইন্ডিয়ান স্টেনগান ৩০৩ রাইফেল মার্ক-৪ রাইফেল, গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়। পাকসেনাদের কাছ থেকে এ লড়াইয়ে উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল রকেট বোম, চাইনিজ এস. এম. জি. অটোমেটিক রাইফেল, রকেট লাঞ্চার প্রভৃতি।
১৯৭১ সালে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীদের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শ উদ্দেশ্য লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন, নির্বাচিত তরুণদের নিয়ে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ‘মুজিব বাহিনী’ Bengal Liberation Forces (BLF) গঠন করা হয় এবং তাদের গেরিলাযুদ্ধ শিক্ষা দেওয়া হয়। বিভিন্ন অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্যের ব্যবহার এবং রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদান করা হয়।
আগরতলা থেকে প্রশিক্ষণ শেষে মুজিব বাহিনীর একটি দল নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে মানিকগঞ্জে প্রত্যাবর্তন করেন এবং হাটিপাড়া ইউনিয়ন এবং বংখুরী গ্রামে অস্থায়ী হেডকোয়ার্টার গঠন করে বিভিন্ন থানাতে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রেরণ করেন।
নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সাটুরিয়ার নীরালীতে পাক বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের একখন্ড যুদ্ধ হয়। এখানেও পাকসেনারা টাঙ্গাইল থেকে ছত্রভঙ্গ হয়ে একটি নৌকাযোগে নিরালীর ভিতর দিয়ে আসতে চেষ্টা করলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিরোধ করে। প্রবল প্রতিরোধের মুখে প্রাক সেনারা ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী কেদারপুর গ্রামে অবস্থান নেয় এবং গুলিবর্ষণ করা শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতেথাকে।
ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমদিকে ঘিওরের নারচিকুস্তা গ্রামে এক যুদ্ধ হয়। সন্ধ্যা ৫টার দিকে একদল পাকসেনা উক্ত স্থানের মধ্য দিয়ে মানিকগঞ্জ রওনা হয়। উক্ত সংবাদ পাওয়ামাত্র শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা রাস্তার দু'পাশে এ্যামবুশ করে অবস্থান নেয় এবং পাক সেনারা তাদের মধ্যে এলে মুক্তিযোদ্ধারা অবিরাম গুলি বর্ষণ করে। রাত ৮টা পর্যন্ত গুলি বিনিময়ের পর দুজন পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং দুজন আহত হয়।এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা এল.এম.জি. রাইফেল, স্টেনগান প্রভৃতি অস্ত্র ব্যবহার করে এবং পাকসেনাদের কাছ থেকে বেশকিছু চাইনিজ রাইফেল উদ্ধার করে।
১৪ ডিসেম্বর সকালে লেছড়াগঞ্জ থেকে আগত একদল পাকসেনার সাথে বালিরটেক-এ এক যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে একজনপাক সৈন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে।
১৫ ডিসেম্বর পলায়মান পাক সৈন্যদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সিংগাইরের গাজিন্দা গ্রামে যুদ্ধ সংঘটিত হয়। পলায়মান পাক সৈন্যদের গাজিন্দা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ করলে দু’দিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘেরাও করে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। পাকবাহিনীর আধুনিক সমরাস্ত্রের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধারা দু'ঘণ্টা যুদ্ধের পর দুর্বল হয়ে পড়লে হঠাৎ করে পিছন দিক থেকে আক্রমণের ফলে মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আনিসুর রহমান(গাজিন্দা), আক্কেল উদ্দিন (গাজিন্দা), শরিফুল ইসলাম (গাজিন্দা), রমিজ উদ্দিন (গাজিন্দা) ঘটনাস্থলেই শহীদ হন।
১৫ডিসেম্বর পাক সেনারা ঢাকা-আরিচা সড়ক দিয়ে পালিয়ে যাবার সময় একদল মুক্তিবাহিনী মানরা গ্রামে তাদের আক্রমণ করে।পাকবাহিনীর অবিরাম গুলি বর্ষণে মোঃ চান মিয়া(দক্ষিণ ডাউলি) ঘটনাস্থলে শহীদ হন।উক্ত দিনেই অন্য একটি পলায়মান পাক সেনা দলকে মুক্তিবাহিনীরা ঢাকা-আরিচা সড়কে পিছু ধাওয়া করে এবং প্রচন্ড গুলি বিনিময়ের পর পাকসেনারা বাথুলি গ্রামে নিরাপদ স্থানে চলে যাবার সময় হঠাৎ করে একটি গুলি শফিউদ্দিন ওরফে আবদুল ওহাবকে বিদ্ধ করে ফলে তিনি সেখানে শহীদ হন।
১৯৭১সালের এপ্রিল মাসে যে মানিকগঞ্জের বিনা প্রতিরোধে পতন হয়েছিল। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণের ফলে মুক্ত হতে শুরু করে এবং ১৪ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জসহ সম্পূর্ণ এলাকা পাক হানাদার মুক্ত হয়। ১৯৭১সালের ১৫ ডিসেম্বর সকাল দশটায় দেবেন্দ্র কলেজের মাঠে বিপুল সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের উপস্থিতিতে এক বিজয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস